সঠিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ : বিবর্তনমূলক বা ঐতিহাসিক মতামত

রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ

সঠিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ : বিবর্তনমূলক বা ঐতিহাসিক মতামত

রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বিবর্তনমূলক মতামত বিশ্লেষণ কর। অথবা, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মতামত সম্পর্কে আলোচনা কর। এ প্রশ্নে আমরা সঠিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ কোনটি তা বিস্তারিত আলোচনা করবো।

রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে অনেক আগে থেকেই। তবে মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রথম উপাদানটি পর্যালোচনা করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে কয়েকটি মতামত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে। এরপর এই বিষয়ে আধুনিক চিন্তা-ধারণা সম্পর্কে জানা গেলো অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে।

 

☞ আরো পড়ুন : অনার্স ১ম বর্ষ রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি সাজেশন ২০২৩

 

যুগ-যুগান্তরের চিন্তা-ভাবনার ফলে রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে, যা মূলতঃ দুই ধরণের। কয়েকটি মতবাদ রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা করে। এছাড়াও কিছু পৃথক মতবাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে এই মতবাদগুলি একেবারে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে অধিকাংশ মতবাদই তাদের গুরুত্ব হারিয়ে গেছে। রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে প্রচলিত মতবাদগুলি হল:

  • ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ।
  • বলপ্রয়োগ মতবাদ।
  • পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ।
  • সামাজিক চুক্তি মতবাদ।
  • ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনবাদ মতবাদ।

 

তবে এর মধ্যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ বা সঠিক মতবাদ কোনটি তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের যুক্তি আছে। তবে আজকে আমরা আলোচনা করবো রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সঠিক মতবাদ কোনটি বা রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ কোনটি?

 

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ কোনটি

ভূমিকা : এখন কিভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা খুবই দুরূহ ব্যাপার। কারণ ইতিহাসে কোথায় কোন প্রমাণ বা রেকর্ড নেই যে, ঠিক কখন কিভাবে রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির ইতিহাস সত্যিই রহস্যবৃত। এ প্রসঙ্গে ডঃ গিলক্রিস্ট বলেছেন – “Of The Circumstance Surrounding The Down Of Political Consciousness, We Know Little Or Nothing From History Where History Fails, We Must Resort To Speculation.

এরপরও রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বহু মতামতের অস্তিত্ব রয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বহু মতামতের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি মতামত হলো ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক মতামত

ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক মতামত
রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ তথ্য গুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক মতামত তথ্যই সর্বপেক্ষ বিজ্ঞান সম্মত এবং গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব। রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ যেসব তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলো তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক তত্ত্ব কে সর্বপেক্ষা গ্রহণযোগ্য তথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এজন্য ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক মতামত গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

প্রফেসর গার্নার তার ” Political Science and government ” গ্রন্থে বলেছেন – The estate is neither the handiwork of God, or the result of superior physical force, Nor the creation of resolution of convention nor a Mere explanation of the family. ” বস্তুত ঐতিহাসিক কর্ম বিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।

রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতামতের মধ্যে প্রখ্যাত আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর বারযাস বলেছেন, ” রাষ্ট্র মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ফল। ” এ তত্ত্বের মূল কথা হলো রাষ্ট্র একদিনে সৃষ্টি হয়নি। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন শক্তি ও উপাদানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র বর্তমানে রূপ পরিগ্রহ করেছে । ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তনমূলক তত্ত্বের পশ্চাতে বিভিন্ন উপাদান কাজ করেছে । রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতামতের বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব আলোচনা করা হলো :

  1. রক্তের সম্পর্ক
  2. অর্থনৈতিক কার্যকলাপ
  3. ধর্ম
  4. যুদ্ধ বিগ্রহ
  5. রাজনৈতিক চেতনা

 

নিচে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতামতের তত্ত্ব বা বিশ্লেষণ করা হলো :

১। রক্তের সম্পর্ক

রাষ্ট্রের কর্ম বিবর্তনের ধারায় রক্তের সম্পর্ক বা আত্মীয়তার বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগ্রহ হল পরিবার। পরিবার সদস্যরা রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরবর্তী সময় গোষ্ঠী ও উপজাতির সৃষ্টি করে ; উপজাতি আরও সংঘটিত হয়ে জাতিতে পরিণত হয় এবং জাতি থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এপর সঙ্গে প্রফেসর ম্যাকাইভার বলেছেন -” আত্মীয়তা বা রক্তের বন্দর সমাজ গড়ে তোলে এবং সমাজ পরিশেষে রাষ্ট্র উৎপত্তি করে। ” রক্তের সম্পর্ক হল পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি এবং শেষাবদি পরিবার রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

 

২। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ

রাষ্ট্রের উৎপত্তির পশ্চাতে আরেকটি শক্তিশালী উপাদান হলো অর্থনৈতিক কার্যকলাপ। প্রাচীন সমাজে মানুষ যখন বহুবলে স্বীকার করে ফলমূল আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত, তখন সমাজপতীর নির্দেশ মোতাবেক সংগৃহীত ফলমূল বন্টন করা হতো। কিন্তু কাল ক্রমে উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভব ও শিল্পের আবির্ভাবের সুবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তি হয়। ফলে মালিক শ্রমিক ধনী-দরিদ্রের কাঠামো গড়ে ওঠে। এর ফলে সমাজের শ্রেণী বৈষম্য দেখা দেয় ফলে ধন সম্পত্তি রক্ষা করা এবং এতো সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসার জন্য নতুন নতুন আইন তৈরি করতে হয়।

ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ফলে বিরুদ্ধে দেখা যায় ফলে নতুন আইন তৈরি হয় এবং বিরোধ নিরসনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।

 

৩। ধর্ম

রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে রক্তের যেমন সম্পর্ক, তেমনি ধর্মের অনুরূপ ভূমিকা আছে। বিভিন্ন পরিবার গোত্র ও জাতির রক্তের বন্ধন একত্রে বসবাসের যোগায়। তেমনি এক ধর্মের লোক একত্রে বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা জন্মে। তাই আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলেছেন ” মানবজাতির একতা পবিত্রতা ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ধর্ম ও স্বাক্ষর ও সীমাহীন হিসেবে পরিচিত “। ধর্মের বন্ধন গোষ্ঠী ও উপজাতির মধ্যে ঐক্য অনুভূতির সৃষ্টি করে। এভাবে ধর্মীয় বন্ধন রাষ্ট্র উৎপত্তিতে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

 

৪। যুদ্ধ বিগ্রহ

ঐতিহাসিক বা বিবর্তন মূলক তত্ত্বের আরেকটি উপাদান হল যুদ্ধবিগ্রহ বা বল প্রয়োগ। প্রাচীনকালের জনসমাজে নানা গোত্র ও উপজাতি বিভক্ত ছিল। এসব উপজাতিগুলো পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য যুদ্ধ বিগ্রহ লিপ্ত থাকতো। শক্তিশালী গোত্র নেতার নেতৃত্বে বিজয়দল পড়ে দলের উপর নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বস্থলী আরপ করত। পরাজিত দলও বিজিত উপজাতির অনুগত্য মেনে নিত। গোত্র নেতা ক্রমোন নয় শক্তি সঞ্চয় অন্য গোত্রের লোকদের পরাজিতকারী রাজ্যসীমা সম্প্রসারণে বল প্রয়োগ আশ্রয় নিতেন । এভাবে বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।

 

৫। রাজনৈতিক চেতনা

ঐতিহাসিক মতামত বা বিবর্তন মতামত এর রাষ্ট্র উৎপত্তির মূলে নানাবিধ সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্র সৃষ্টি এর জন্য রাজনৈতিক সচেতনা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক চেতনা বিশুদ্ধ ধর্মভাষা ঐতিহ্য মানুষকে স্বতন্ত্র ভূখণ্ড ও সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠিত হয়। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো ও নিরাপত্তা আকাঙ্ক্ষা মানুষের মনে রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে।

 

উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ যত তথ্য প্রচলিত আছে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করলে নির্দ্বিধায় ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনমূলক মতবাদ তথ্যকে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। এ তথ্যের বিরুদ্ধে তেমন সমালোচনা নেই। বিবর্তনমূলক তত্ত্বে বা বিবর্তনমূলক মতবাদ সমাজ বিবর্তনের যে পর্যায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে এবং পর্যাগুলোর পশ্চাতে যে সকল উপাদান কাজ করছে তা খুবই যুক্তিযুক্ত। তাই প্রফেসর গার্নার মনে করেন, রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়, পরিবার সম্প্রসারিত হয়েও জন্ম লাভ করেনি বা শক্তির বলেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হয়েছে বিবর্তনের ধারায়।

 

☞ আরো পড়ুন : অনার্স ১ম বর্ষ সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি ২০২৩ [ সাজেশন ]

 

আমরা এই পোস্টে জানতে পেরেছি রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ কোনটি বা রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সঠিক মতবাদ কোনটি? রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ – বিবর্তনমূলক বা ঐতিহাসিক মতামত প্রশ্নটির উত্তরে উপরোক্ত আলোচনা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ এটি সঠিক মতবাদ। কারণ, এটির কোনো সমালোচনা নেই বললেই চলে। তাই বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিবর্তনমূলক মতামত বা ঐতিহাসিক মতামত সঠিক বলে বিবেচনা করেন।

2 comments

  1. Pingback: প্যারেটোর এলিট তত্ত্ব বর্ণনা কর বা এলিট আবর্তন নীতি বিশ্লেষণ কর

  2. Pingback: গণসংখ্যা নিবেশন গঠনের ধাপ গুলো বর্ণনা কর [ অনার্স ৩য় বর্ষ ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *