লিখিত ও অলিখিত সংবিধান এর তুলনামূলক পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য

লিখিত ও অলিখিত সংবিধান

আজকের পোস্টে আমরা জানতে পারবো লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যলিখিত ও অলিখিত সংবিধান এর তুলনামূলক পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য। এখানে মূলত আইনসভার মাধ্যমে প্রণীত এবং বিভিন্ন সময় থেকে প্রচারিত বিভিন্ন প্রকার প্রথার সমন্বয়ে গঠিত এ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থক্য ও বৈসাদৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

লিখিত ও অলিখিত সংবিধান

প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধান থাকে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সরকারের রূপ সংবিধানের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে কি সম্পর্ক থাকবে তাও সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়।

 

সংবিধান কি?

সংবিধান হলো রাষ্ট্রের যেসব বিধিবদ্ধ নিয়ম ও নীতিমালা, যা দ্বারা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। একটি রাষ্ট্রের সংবিধান সরকারের সৃষ্টি নয়, বরং সরকারি সংবিধানের সৃষ্টি। সাধারণভাবে বলতে গেলে সংবিধান হলো একটি দেশের সরকার কিভাবে গঠিত হয় ও পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে বিভিন্ন নিয়মাবলির সমষ্টিকে সংবিধান বলা হয়। সংবিধানকে ভিত্তি করে সরকার সংঘটিত হয় এবং এটা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যেমন – শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন করে দিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করে।

এরিস্টটল সংবিধান ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে ” সংবিধান এমন একটি জীবন পদ্ধতি যা রাষ্ট্র নিজের জন্য বেছে নিয়েছে। ” ( Consistisation Is The Way Of Life That The State Has Chosen For Itself. )

তবে সংবিধানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সংবিধানের সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অভিমত রয়েছে। এদের মধ্যে, সি. এফ. স্ট্রং ও লর্ড ব্রাইস ও অধ্যাপক এইচ. ফাইনার প্রমুখ।

আইনসভার মাধ্যমে প্রণীত এবং বিভিন্ন সময় থেকে প্রচারিত বিভিন্ন প্রকার প্রথার সমন্বয়ে গঠিত এ দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে সংবিধানকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তবে লিখিত সংবিধান ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যগুলো আলোচনার পূর্বে লিখিত ও অলিখিত সংবিধান বলতে কি বুঝায় তা জেনে নেওয়া আবশ্যক।

 

লিখিত সংবিধান

লিখিত সংবিধান বলতে আমরা সেই সংবিধানকে বুঝি, যাতে শাসনতান্ত্রিক বিষয়সমূহ এক বা একাধিক দলিলে লিখিত থাকে। Prof. J. Garner বলেছেন, ” লিখিত সংবিধানের শাসন সংক্রান্ত বিষয় সমূহ দলিল লিপিবদ্ধ থাকে। শাসনকার্য কিভাবে পরিচালিত হবে এবং বিভিন্ন বিভাগসমূহ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে তা পূর্বেই নির্ধারিত হয়। যেমন, আমেরিকা, ভারত, কানাডা ও বাংলাদেশ ইত্যাদি এসব দেশগুলো লিখিত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত।

 

অলিখিত সংবিধান

অলিখিত সংবিধান হলো প্রচলিত প্রথা, দেশাচার, রাজনীতিকে বোঝায়। এগুলো কোন দলিলের সন্নিবেশিত না থাকলেও লিখিত সংবিধানের মতো এগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ব্রিটেন এর সংবিধানকে অলিখিত সংবিধান বলা হয়ে থাকে।

 

নিম্নে লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য উল্লেখ করা হলো :

 

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলো বিচার করলে উভয় ধরনের সংবিধানের মধ্যে কতগুলো পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের পার্থক্যগুলো বা বৈসাদৃশ্যগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :

  • আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রে : লিখিত সংবিধানের সাথে আনুষ্ঠানিকতা জড়িত থাকে। কোন পরিশোধ বা কনভেনশনে আনুষ্ঠানিকতায় ঘোষিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বিজয় দিবস কে সামনে রেখে গণপরিষদ সদস্যের স্বাক্ষর দানে অনুষ্ঠিত গৃহীত হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধান এমনিতে প্রণীত ও গৃহীত হয় না। এটা প্রচলিত প্রথা, আচার-আচরণ ও বিচারক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে । বৃটেনের সংবিধান প্রথা নির্ভর এবং জেনিংস প্রথা সমূহকে শাসনতন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি বলে অতিবাহিত করেছেন।
  • নাগরিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে : প্রচলিত ধারণা হলো নাগরিক স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষার জন্য সংবিধান লিখিত হওয়া প্রয়োজন। সংবিধান অধিকারসমূহ বিধিবদ্ধ থাকলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা অনুযায়ী এই অধিকার ক্ষুন্ন করতে পারেনা। কিন্তু ধারণা করা হয় অলিখিত সংবিধান নাগরিক অধিকার রক্ষা করার ক্ষেত্রে অপকারিত দুর্বল ভূমিকা পালন করে।
  • সর্বোচ্চ আইনের ক্ষেত্রে : লিখিত আইনকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই সকলেই সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকে কাজ করতে বাধ্য থাকে। কোন সময় খেয়াল খুশিমতো কোন আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ লিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে সংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধানের তা করা হয় না। ব্রিটেনের সাংবিধানিক ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
  • বিচার বিভাগের প্রধান্যের ক্ষেত্রে : লিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগের প্রধান্য থাকে। এই বিধানুসারে সকল বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্র ভাবে বন্টিত হয়। কোন বিভাগ কোন বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বিচার বিভাগের রায়ই চূড়ান্ত। অপরদিকে অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য হলো বিচার বিভাগের পরিবর্তে আইনসভার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের থাকে না। এক্ষেত্রে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কি ব্যবস্থা ব্রিটেনের বর্তমান।
  • সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে : লিখিত সংবিধান সংশোধন করতে বিশেষ ও জটিল পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। লিখিত সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘতর এবং কঠিন। কিন্তু অলিখিত সংবিধান সমাজে পরিবর্তনশীল বিদায় এর জন্য কোন বিশেষ বা জটিল পদ্ধতির অনুসরণ করতে হয় না। এটাই হল মূল পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য।
  • প্রকৃতিগত পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য : লিখিত সংবিধানের দুষ্পপরিবর্তনীয়। লিখিত সংবিধানের স্থায়িত্ব থাকে বলে তা সহজে পরিবর্তন করা যায় না। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। অন্যদিকে, লিখিত সংবিধান ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য দেখলে বুঝা যায় অলিখিত সংবিধান সুপরিবর্তনীয় প্রকৃতি মত হয়ে থাকে। প্রয়োজন মত এ সংবিধান ধারা পরিবর্তন করে দ্রুত জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করা সম্ভব।
  • সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইন : অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারণাসমূহ কোন দলিলে লিপিবদ্ধ থাকে না। পার্থক্য গত দিক থেকে লিখিত সংবিধানের সাধারণ আইন এবং সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য পরিখিত হয়। এ সংবিধানে বিভিন্ন আইন সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে বলেন জঘন্য গুন সহজেই সাধারণ আইন এবং সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে।
  • লিপিবদ্ধকরণ দিক থেকে : লিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারণা সমূহ ১ বা একাধিক দলিলের লিপিবদ্ধ থাকে। এ সংবিধানের জনগণের মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকে। ফলে ক্ষমতাসীল দল ইচ্ছা করলে জনগণের অধিকার হরণ করতে পারে না। কিন্তু অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ ধারণাসমূহ কোন দলিল পবদ্ধ থাকে না।

 

☞ আরো পড়ুন : সঠিক রাষ্ট্রের উৎপত্তি মতবাদ : বিবর্তনমূলক বা ঐতিহাসিক মতামত

FAQ : Frequently Ask Question

 

অলিখিত সংবিধান কোন দেশের?

উত্তর : অলিখিত সংবিধান ব্রিটেন এর সংবিধান।

 

কোন দেশের সংবিধান নেই?

উত্তর : কানাডা, চীন, নিউজিল্যান্ড দেশের সংবিধান নেই।

 

কোন কোন দেশে লিখিত সংবিধান আছে?

উত্তর : আমেরিকা, ভারত, কানাডা ও বাংলাদেশ ইত্যাদি এসব দেশগুলো লিখিত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত।

 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংবিধান কোন দেশের?

উত্তর : পৃীবীর সবচেয়ে বড় সংবিধান হলো ভারত এর।

 

বিশ্বের সবচেয়ে ছোট সংবিধান কোন দেশের?

উত্তর : বিশ্বের সবচেয়ে ছোট সংবিধান হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা USA

 

শেষ কথা : উপর্যুক্ত আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক ও অবাস্তব। এ পার্থক্য মোটেই মৌলিক নয়। তবে যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত না হলেও সংবিধানের এর শ্রেণীবিভাগের বিধিবদ্ধ অংশকে ভিত্তি করে অলিখিত অংশের সৃষ্টি হয়। আবার বিপরীত ক্রমে এভাবেই অলিখিত সংবিধানের লিখিত অংশের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ অলিখিত সংবিধানের যেমন অনেক লিখিত দিগ রয়েছে তেমনি লিখিত সংবিধানেরও অনেক অলিখিত দিক রয়েছে। এটিই হলো লিখিত সংবিধান ও অলিখিত সংবিধানের মূল পার্থক্য।

 

আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন :

Facebook : https://facebook.com/rvwbd/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *